সাইপ্রাস

ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ দেশ সাইপ্রাস। গ্রিক কিংবদন্তি অনুসারে সৌন্দর্য ও ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতির জন্ম হয় এ দ্বীপে। ফলে এ দ্বীপকে আফ্রোদিতির দ্বীপও বলা হয়। তবে বাস্তবেও অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই দ্বীপ দেশ। পর্যটনের জন্য বিখ্যাত এ দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২৮ হাজার ৩৮১ মার্কিন ডলার। প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার দেশটি ১৯৬০ সালে ব্রিটিশ কবলমুক্ত হয়। তবে এ দ্বীপের রয়েছে কয়েক হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস।

সাইপ্রাস ১৯৬০ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের পরপরই অর্থা ১৯৬১ সালে দেশটি কমনওয়েলথে যোগ দেয়। অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ দেশ এটি। ২০০৪ সালের ১ মে দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হয় এবং ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ইউরো মুদ্রা গ্রহণ করে। ১৯৭৪ সালে এখানে জাতিগত গ্রিক ও তুর্কিদের মধ্যে সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হয়। এ সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ে গ্রিস ও তুরস্ক। ফলে ভূখণ্ডগতভাবে সাইপ্রাস দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক চুক্তির মাধ্যমে এর এক অংশের নাম হয় গ্রিক সাইপ্রাস এবং অন্য অংশের নাম হয় তুর্কি সাইপ্রাস। দুই সাইপ্রাসকে বিভক্তকারী রেখাকে জাতিসঙ্ঘ নাম দিয়েছে ‘গ্রিন লাইন’। তবে পশ্চিমাদের একপক্ষীক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বিশ্বে সাইপ্রাস বলতে গ্রিক সাইপ্রাসকেই বোঝানো হয়ে থাকে।

সাইপ্রাসের ভৌগোলিক অবস্থান

ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত। ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপগুলোর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপ এটি। এর পশ্চিমে গ্রিস, পূর্বে লেবানন, সিরিয়া এবং ইসরাইল, উত্তরে তুরস্ক ও দক্ষিণে মিসর। এখানকার আবহাওয়া সাধারণত গরম এবং শুষ্ক। নভেম্বর থেকে মার্চ অর্থাৎ শীতকাল হচ্ছে চাষাবাদের মৌসুম। শীতের এ মৌসুমে এখানে যথেষ্ট বৃষ্টিপাত হয়। শীতকালে এখানে নানা ধরনের সাইক্লোনও দেখা দেয়। এ সাইক্লোনগুলো উৎপন্ন হয় ভূমধ্যসাগরে। আর মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে এখানকার আবহাওয়া থাকে শুষ্ক। এখানকার গড় বৃষ্টিপাত ৫৫০ মিলিমিটার। গড় তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তাপমাত্রার এ অবস্থা দেশটিতে বিশাল পর্যটন শিল্প বিকাশে ভূমিকা রেখেছে।

ইতিহাস

সাইপ্রাসকে বলা হয় দেবী আফ্রোদিতির জন্মস্থান। এখানে মানব বসতির আদিভূমি হচ্ছে দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকা ‘ইতোকরেমনস’। খ্রিষ্টজন্মের ১০ হাজার বছর আগে এখানে শিকারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহকারীদের বসতি ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তারা খ্রিষ্টপূর্ব আট হাজার ২০০ বছর আগে স্থায়ীভাবে গ্রামীণ জীবনের আওতায় আসে। এখানে প্রথম সভ্য মানুষ আসে আনাতোলিয়া থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২ হাজার ৪০০ বছর আগে। আর গ্রিকরা আসে খ্রিষ্টপূর্ব এক হাজার ৬০০ বছর আগে। এর পর আশপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন সময় নানা জাতি ও বর্ণের লোক এখানে এসেছে। সাইপ্রাস ইতিহাসের বিভিন্ন সময় গ্রিক, রোমান, পারসীয় এবং মিসরীয় শাসকদের অধীনে শাসিত হয়। ৩৯৫ সালে এ দ্বীপটি বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। আরবরা এটি দখল করে ৬৪৩ সালে। ১১৯১ সালে তৃতীয় ক্রুসেডের সময় এটি দখল করে ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড। ১৫৩৯ সালে অটোমানরা এটি দখলে নেয়। ১৮৭৮ সালে দ্বীপটি ব্রিটেনের একটি সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ১৯২৫ সালে দ্বীপটিকে ব্রিটিশরা নিজেদের একটি কলোনি বলে দাবি করে। অবশেষে ১৯৬০ সালের ১৬ আগস্ট এক চুক্তির মাধ্যমে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে।

এক নজরে সাইপ্রাস
দেশের নাম - সাইপ্রাস
সরকারি নাম - রিপাবলিক অব সাইপ্রাস
রাজধানী - নিকোশিয়া
সরকারি ভাষা - গ্রিক ও তুর্কি
জাতিগত ভিন্নতা - ৮০ শতাংশ গ্রিক, ১৬ শতাংশ তুর্কি এবং ৪ শতাংশ অন্যান্য
সরকার পদ্ধতি - রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার
স্বাধীনতা - ১৯৬০ সালের ১৬ আগস্ট ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে
স্বাধীনতা দিবস - ১ অক্টোবর
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ গ্রহণ - মে ১, ২০০৪
আয়তন - নয় হাজার ২৫১ বর্গকিলোমিটার
জনসংখ্যা - ৮ লাখ ১ হাজার ৬০০ জন
জনসংখ্যার ঘনত্ব - প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৮৫ জন
মাথাপিছু আয় - ২৮ হাজার ৩৮১ মার্কিন ডলার
মুদ্রা - ইউরো

অর্থনৈতিক অবস্থা

সম্প্রতি সাইপ্রাসের অর্থনীতি উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আইএমএফ’র মতে, দেশটির মাছাপিছু আয় হচ্ছে ২৮ হাজার ৩৮১ ডলার। তারা অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতি অনুসরণ করছে। ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তারা ইউরো মুদ্রাকে তাদের নিজস্ব মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করে। ইতোমধ্যে তারা ভূমধ্যসাগর থেকে তেল, গ্যাস আহরণের জন্য মিসর ও লেবাননের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া দেশটির আয়ের প্রধান খাতগুলো হচ্ছে পর্যটন, শিক্ষা, বাণিজ্য ইত্যাদি।

সরকার পদ্ধতি

দেশটির সরকারব্যবস্থা হচ্ছে রাষ্ট্রপতিশাসিত। দেশটির সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট। যিনি প্রতি পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। নির্বাহী বিভাগ পরিচালনা করেন সরকার, আইন বিভাগ পরিচালনা করেন হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস এবং বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। ১৯৬০ সালে প্রণীত সংবিধানে বলা হয়, দেশটির প্রেসিডেন্ট হবেন অবশ্যই একজন গ্রিক সাইপ্রিয়ট বা জাতিগত গ্রিক এবং তুর্কি সাইপ্রিয়ট একজন হবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট যিনি ওই গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। ১৯৮৩ সালে তুর্কি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অংশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তবে এ পর্যন্ত তুরস্ক ছাড়া আর কোনো দেশে তাদের সমর্থন করেনি। দেশটির হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের সদস্যসংখ্যা ৫৯ জন। এর মধ্যে ৫৬ জন সরাসরি নির্বাচিত হন এবং বাকি তিনটি আসন মেরোনাইট, আর্মেনিয়ান এবং ল্যাটিন সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত।

পর্যটন

দেশটির আয়ের অন্যতম উৎস পর্যটন। সাইপ্রাসে প্রতি বছর গড়ে ২৪ লাখ বিদেশী পর্যটক আসেন। ২০০৬ সালে মোট জিডিপি’র ১০ দশমিক ৭ শতাংশ এসেছে পর্যটন শিল্প থেকে। ১ লাখ ১৩ হাজারের বেশি লোকের অর্থাৎ দেশের মোট চাকরীজীবীর ২৯ দশমিক ৭ শতাংশের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে এ শিল্পে। ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরাম এর ২০০৭ সালের সূচকে পর্যটন শিল্পে সাইপ্রাসের অব¯'ান বিশ্বে ২০তম। দ্য সাইপ্রাস ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন (সিটিও) নামের একটি সংগঠন সরকারের পক্ষে সাইপ্রাসের পর্যটন শিল্পের তত্ত্বাবধানে করে থাকে।

প্রতিরক্ষাব্যবস্থা

দেশটির প্রধান প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘সাইপ্রিয়ট ন্যাশনাল গার্ড’। স্থল, নৌ এবং বিমানবাহিনীর সমন্বয়ে এটি একটি যৌথ প্রতিরক্ষা বাহিনী। সাইপ্রিয়ট ন্যাশনাল গার্ডের বর্তমান প্রধান হচ্ছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল কনস্টান্টিনস বিসবিকাস।

ধর্ম

গ্রিক সাইপ্রিয়টদের বেশিরভাগই গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের সদস্য এবং তুর্কি সাইপ্রিয়টদের বেশিরভাগই মুসলিম। ইউরোবেরোমিটার ২০০৫ অনুসারে, সাইপ্রাস হচ্ছে ইউরোপের প্রধান পাঁচটি ধার্মিক দেশের একটি। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত যে পাঁচটি দেশে রাষ্ট্রধর্ম আছে সাইপ্রাস তাদেরও একটি। সাইপ্রাসের রাষ্ট্রধর্ম হচ্ছে ‘সাইপ্রিয়ট অর্থোডক্স চার্চ’।

শিক্ষা

সাইপ্রাসের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। সাইপ্রাসের মোট জিডিপি’র ৭ শতাংশ ব্যয় হয় শিক্ষার জন্য। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে যা তৃতীয় সর্বোচ্চ। সাইপ্রাসে একাধিক বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তবে সাইপ্রাসের উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীদের অনেকেই গ্রিস, ব্রিটেন, তুরস্ক, ইউরোপের অন্যান্য দেশ এবং উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে থাকে।

সংস্কৃতি

খেলাধুলা, গান, সাহিত্য, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ পদ্ধতি এবং পরিবহনব্যবস্থাসহ জীবনের নানা ক্ষেত্রে সাইপ্রিয়টদের রয়েছে সম্পূর্ণ নিজস্ব ঐতিহ্য।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

অস্ট্রেলিয়ান গ্রুপ, সিএন, সিই, ইইউ, ফাও, আইএইএ, ন্যাম, ডব্লিউটিও, জাতিসঙ্ঘ ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্য হচ্ছে সাইপ্রাস।

Don't Miss A Single Updates

Remember to check your email account to confirm your subscription.

Blogger
Disqus
Post a comment ➜

No Comment