মালদ্বীপ

ভারত মহাসাগরের বুকে দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ দেশ বিশ্বের সবচেয়ে নিচু দেশ। পর্যটনের জন্য বিখ্যাত এ দেশের সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্চ উচ্চতা মাত্র দুই দশমিক তিন মিটার এবং গড় উচ্চতা মাত্র এক দশমিক পাঁচ মিটার। এক হাজার দুই শ’রও বেশি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত মালদ্বীপ।

মালদ্বীপ নামকরণ

মালদ্বীপের নামকরণ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ লক্ষ করা যায়। কেউ কেউ দাবি করেন মালদ্বীপ অর্থ হচ্ছে ‘মেল দ্বীপ রাজ’ বা পুরুষশাসিত রাজ্য। মূলত ‘দ্বীপ’ একটি সংস্কৃত শব্দ আর ‘মাল’ শব্দটি দেশটির রাজধানীর নামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ঔপনিবেশিক আমলে ডাচ্রা তাদের নথিপত্রে এ দ্বীপপুঞ্জের নাম মালদ্বীপ বলে উল্লেখ করেন। পরে ব্রিটিশরাও একই নাম ব্যবহার করেন, যা দেশটির স্থানীয় নাম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। শ্রীলঙ্কান প্রাচীন সাহিত্য ‘মহাবংশ’-এ মালদ্বীপকে বলা হয়েছে ‘মহিলাদ্বীপ’ বা নারীদের দ্বীপ। তবে কিছু কিছু পণ্ডিত মনে করেন, মালদ্বীপ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত মালাদ্বীপ থেকে যার অর্থ ফুলের মালার দ্বীপ। তবে প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে এ দ্বীপকে বলা হয়েছে ‘লাক্কাদ্বীপ’ বা শত হাজার দ্বীপ। তবে মালদ্বীপে এক হাজারের বেশি দ্বীপ থাকলেও এক লাখ দ্বীপ নেই। আবার আরব পর্যটক ইবনে বতুতা এ দ্বীপকে বলেছেন ‘মহল দ্বীপ’ বা রাজপ্রাসাদের দ্বীপ। আর মালদ্বীপের রাষ্ট্রীয় প্রতীকে ইবনে বতুতার ব্যাখ্যার নিরিখে এখনো মহল বা রাজপ্রাসাদের ছবি ব্যবহৃত হয়।

ইতিহাস

ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি পর্যালোচনা করে নিশ্চিত হওয়া যায় মালদ্বীপে বসতি স্থাপনকারীরা ছিলেন দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর লোক। সঙ্গম যুগে (খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০-৩০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে) এরা ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের কেরালা রাজ্য থেকে সেখানে যায়। প্রধানত জেলে সম্প্রদায়ের লোকরাই সেখানে প্রথম যায়। তবে প্রাচীন তামিল জনগোষ্ঠীর কিছু লোকও সেখানে যায়। মূলত এ দু’টি জনগোষ্ঠীর লোকদেরই এ দ্বীপের আদি বসতি স্থাপনকারী হিসেবে ধরা হয়। এরপর সময়ে সময়ে মালদ্বীপের দ্বীপগুলোতে বহু ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কান মানুষ বসতি স্থাপন করে। বারো শতকে এ দ্বীপপুঞ্জে পারসিক মুসলমানদের আগমন ঘটে। তারা ‘বিদেশী সাধু’ বলে পরিচিত ছিলেন।

এই বিদেশী সাধু বা পারসিকরা মালদ্বীপবাসীকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দেন। আর পারসিকদের আগমনের পর থেকেই মালদ্বীপ আরব বণিকদের জন্য একটি অন্যতম বাণিজ্যিক যাত্রাবিরতিস্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বিজয়ের পরপরই অর্থাৎ ১১৫৩ সালে পারসিক মুসলমানরা এখানে ‘স্বাধীন ইসলামি সালতানাত’ প্রতিষ্ঠা করেন। তারা সুলতান নাম ধারণ করে ১৯৬৮ সাল পযন্ত এই সালতানাতব্যবস্থা কায়েম রাখেন। মাঝে ১৮৮৭ সাল থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত দেশটি ব্রিটিশদের আশ্রিত রাজ্য হিসেবে ছিল। ১৯৬৫ সালের ২৬ জুলাই পর্যন্ত এ দ্বীপরাষ্ট্রটি স্বাধীন হয়ে যায়। ১৯৫৩ সালে দেশটিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছিল। তবে ১৯৬৮ সাল থেকে দেশটিতে প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম আছে। এটি রাষ্ট্রপতিশাসিত একটি দেশ।

স্বাধীনতা

১৯৬৫ সালের ২৬ জুলাই দেশটি ব্রিটিশ আশ্রিত রাজ্যে থেকে স্বাধীন হিসেবে আবির্ভূত হয়।

একনজরে মালদ্বীপ
দেশের নাম - মালদ্বীপ
রাষ্ট্রীয় নাম - দ্য রিপাবলিক অব মালদ্বীপস
রাজধানী - মালে
ভাষা - দ্বিবেহি
স্বাধীনতা - ২৬ জুলাই ১৯৬৫
আয়তন - ২৯৮ বর্গ কিলোমিটার
জনসংখ্যা - প্রায় তিন লাখ ৫০ হাজার
ঘনত্ব - প্রতি বগর্ কিলোমিটারে ১১০৫ জন বা প্রতি বর্গ মাইলে ২৮৬২ জন (পরিসংখ্যান ২০০৬)
মাথাপিছু আয় - জনপ্রতি ৪৯৫০ ডলার (ইউএস)
মুদ্রা - মালদ্বীপিয়ান রুপিয়া

সর্বশেষ নির্বাচন

দেশটিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. মামুন আবদুল গাইউম। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবিতে ২০০৪ ও ২০০৫ সালে দেশটিতে এক অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। অবশেষে ২০০৮ সালের ৯ অক্টোবর দেশটিতে বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন ছয়জন। ২৮ অক্টোবর দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সাবেক সাংবাদিক মুহাম্মদ নাশিদ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ড. ওয়াহিদ। এর আগে দেশটির ক্ষমতায় ছিলেন ড. মামুন আবদুল গাইউম। তিনি ছয়বার দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে কোনোবারই তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না।

রাজনীতি

দেশটিতে বর্তমানে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন সরকারপ্রধান। প্রেসিডেন্টই ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের নিয়োগ দেন এবং তিনি হচ্ছেন তাদের প্রধান। প্রেসিডেন্ট পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তবে দেশটিতে অমুসলিমদের কোনো ভোটাধিকার নেই। দেশটিতে ৫০ সদস্যের একটি মজলিসে সুরা আছে। এরা পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এই ৫০ সদস্যের মধ্যে আটজন প্রেসিডেন্ট কর্র্তৃক মনোনীত হন। এই একটি উপায়েই মহিলারা সংসদে প্রবেশের সুযোগ পান। দেশটিতে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে ২০০৫ সালে। সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইউম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এ দলের নাম ‘দ্য মালদ্বীপিয়ান পিপলস পার্টি’। একই বছর আরেকটি রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হয় ‘মালদ্বীপিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ হিসেবে। এভাবেই দেশটিতে বহুদলীয় রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়।

অর্থনীতি

প্রাচীনকাল থেকেই সামুদ্রিক মাছ হচ্ছে দেশটির অর্থনীতির মূল ভিত্তি। তবে বর্তমানে দেশটি পর্যটন শিল্পেও যথেষ্ট উন্নতি করেছে। বলা যায়, দেশটির সবচেয়ে বড় শিল্প এখন পর্যটন। মোট আয়ের ২৮ শতাংশ এবং মোট বৈদেশিক আয়ের ৬০ শতাংশই আসে পর্যটন শিল্প থেকে। ১৯৮৯ সালে দেশটির সরকার প্রথমবারের মতো অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ সময় বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উদারনীতি গ্রহণ করা হয়। গত এক দশক যাবৎ দেশটির জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭.৫ শতাংশের বেশি।

প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

ক্ষুদ্র হলে দেশটিতে আছে নিজস্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। দ্য মালদ্বীপ ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স (এমএনডিএফ) নামে তাদের একটি নিজস্ব যৌথ প্রতিরক্ষা বাহিনী আছে। এই বাহিনীর মূল কাজ দেশের নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করা। এ বাহিনীর হাতে দেশটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য পদক্ষেপ নিতে পূর্বানুমোদন দেয়া আছে। কোস্টগার্ড, ফায়ার অ্যান্ড রেসকিউ সার্ভিস, ইনফেন্ট্রি সার্ভিস, ডিফেন্স ইনস্টিটিউট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলো এমএনডিএফ’র বাহিনী পরিচালনা করে থাকে।

Don't Miss A Single Updates

Remember to check your email account to confirm your subscription.

Blogger
Disqus
Post a comment ➜

No Comment