ইস্তাম্বুল

পৃথিবীর তিনটি বাজারের চমৎকার সাদৃশ্য দেখে আমি বরাবরই অভিভূত কায়রোর খানে-খলিলি, দিল্লির চাঁদনি চক ও ইস্তাম্বুলের গ্র্যান্ড বাজার। সব প্রাচীন শহরেই এ ধরনের বাজার আছে কিন্তু আয়তনে, বৈচিত্র্যে এবং বৈশ্বিক চারিত্র্যে এরা তিন সহোদরা। বহুবার আগুনে পুড়েও এই গ্র্যান্ড বাজার শেষ হয়ে যায়নি; বরং দিনে দিনে তার শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে।

আমি অতীতে ফিরে যেতে চাইলাম। কারণ মানুষের অস্বাভাবিক ব্যস্ততা, কোলাহল এবং হাশিশ মাখা মসলার গন্ধ আমায় ক্লান্ত করে তুলেছে। আনোয়ার আমাকে জোর করে কফি পান করায় আর আশ্বস্ত করে যে, রাতে আমরা অবশ্যই ব্যালে ড্যান্স দেখতে যাব, যেখানে ‘বাঙালি বাবু’ স্বস্তি পাবে।

আমি হেসে বলি, আপাতত আমাকে বসফরাসের কাছে নিয়ে চলো যেন পানি আমার চোখকে শীতল করতে পারে। বাদামি, শ্বেত আর লালমুখো মানুষ দেখে দেখে আমি ক্লান্ত, অবসন্ন।

আমরা বসফরাসের পাশের একটি ফিশ-রেস্টুরেন্টে বসি। পূর্ব পাড় থেকে দুই চোখ ভরে দেখা যায় বসফরাসের ওপাড়ে ঝিকমিক করা ওল্ড সিটি পুরনো প্রেমিকাদের নগ্ন নিরাভরণ রূপসহ। আমি আনোয়ারের কাছে জানতে চাই এই বসফরাস দৈর্ঘে-প্রস্থে কত?
আনোয়ার দীর্ঘ বর্ণনায় অনভ্যস্ত। খুব আস্তে বলল কুড়ি মাইল লম্বা, আধ মাইল থেকে দেড় মাইল চওড়া; গড় গভীরতা ১৬৪ ফুট।
আরো কিছু বলো, নইলে আমি ঘুমিয়ে পড়ব!

আমি তোমার মতো ইতিহাসে হাঁটি না। আমার বিষয় কাঠখোট্টা। বইয়ের পাতা থেকে সামান্য তথ্য দিচ্ছি ঝোলায় ভরতে পারো। বসফরাসের সবচেয়ে অপ্রশস্ত কোমর রুমেলি দুর্গ ও আনাদ্লুর মাঝে ২৩০০ ফুট মাত্র চওড়া। উত্তর প্রান্তের ব্লুুুুযুাক সি’র পানি দক্ষিণের মার্মারা সাগর থেকে সাড়ে নয় ফুট উঁচু। সে কারণে ওপরের পানি সব সময় উত্তর থেকে দক্ষিণে যায়। কিন্তু নিচের পানি বয় উল্টা দিকে।

কিভাবে? আমি সোজা হয়ে বসি।
নিচের পানি দক্ষিণ থেকে উত্তরে যায়, কারণ ব্লুুুুযুাক সি’র লবণাক্ততা বেশি। অসমোসিসের থিওরি জানো তো?
তার মানে, বিনা শ্রমে পার হতে চাইলে আমাকে ব্লুুুুযুাক সি’র পানিতে ভেসে থাকতে হবে আর মার্মারায় ডুব দিতে হবে?
সাহ্। যদি তুমি কুড়ি মাইল পথ ডুবে থাকতে পারো অথবা বসফরাসের সি-বাসের প্রপেলারে কচু কাটা না হও।
হেসে বললাম, চলো দোস্ত; তার চেয়ে আবার ব্লুুুু মস্কে গিয়ে ঢুকি।

সকালে যখন ব্লুুুুমস্কে ঢুকি আমরা, তখন ভেতরের রঙ ছিল সোনালি। দুপুরে রঙ হবে হলুদ, বিকেলে কমলা, সন্ধ্যায় নীল ও সূর্যোদয়ে লাল। এই রঙের খেলাই ব্লুুুু মস্কের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ! সকালের সোনালি রঙে রাঙা তন্বী নীল মসজিদকে দেখে আমাদের মন ভরেনি। এবার যেতে হবে পূর্ণযৌবনা রূপসীকে দেখতে? দ্বিধা নিয়ে বললাম, তার চেয়ে চলো টপকাপি যাই?
চলো, নো প্রোবলেম।

‘পিস উই ইউথ আই অ্যাম দ্য লাইট অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ লেখা বিখ্যাত খ্রিষ্টবাণীকে পাশ কাটিয়ে আমরা পৌঁছুলাম টপকাপি প্যালেসে। তুর্কি মুসলিমদের হাতে গড়া বিস্ময়কর প্রাসাদ এটি। প্রথমটির নাম ওল্ড প্যালেস; বায়েজিদ এলাকায় অবস্থিত।
টপকাপি প্রাসাদ মূলত খিলাফতের শেষ চিহ্ন। ১৪৬৫ থেকে ১৪৭৮-এ গড়া এই প্রাসাদ বহু বিবর্তনের সাক্ষী। প্রায় প্রতিজন সুলতান এতে কিছু না কিছু সংযোজন করেছেন বলে এই প্রাসাদের গঠনে কোনো একক বিশিষ্টতা নেই। দিল্লির লাল কেল্লায় যে ধরনের বহু রুচির সমাবেশ, টপকাপি প্রাসাদও তেমনি।

তবে টপকাপির চেয়ে বড় কোনো রাজভবন পৃথিবীতে আছে কি না সন্দেহ। চার হাজার লোকের আবাসযোগ্য এই প্রাসাদ ৭০ হেক্টর এলাকা নিয়ে নির্মিত। ৪০০ বছরে এখানে কাটিয়েছেন ২৫ জন সুলতান; বাইজেন্টিয়াম মহাশাসকরা!

বাইজেন্টিয়াম শব্দটি আমাকে বহুবার বিভ্রান্ত করেছে। ইস্তাম্বুল, কনস্টান্টিনোপল্স, বাইজেন্টিয়াম, তুরস্ক ও আঙ্কারা ছাত্র বয়সে ভুগিয়েছে খুব। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় জানেসারি শব্দের উৎপত্তি খুঁজতে আমি প্রায় বারো দিন খুলনার (বয়রা) পাবলিক লাইব্রেরিতে কাটিয়েছি। সেখানে এনসাইক্লোপিডিয়া ছিল না বলে বাল্যশ্রম সার্থক হয়নি।

রোমানদের পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী এই বাইজেন্টিয়াম পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণ ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকার কেন্দ্রভূমি ছিল। বাইজেন্টিয়াম একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ বসফরাসের উপকূল। সাম্রাজ্য রোমানদের হলেও সেই আলেক্সান্ডারের সময় থেকেই সাংস্কৃতিক প্রাধান্য ছিল গ্রিকদের। সম্রাট কনস্টান্টাইন তার রাজধানী রোম থেকে ইস্তাম্বুলে স্থানান্তর করে এর নামকরণ করেন কনস্টান্টিনোপল্ (৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে)। প্রায় এক হাজার বছর শহরটি এ নামেই পরিচিতি ছিল।

আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে তুরস্ক, আর্মেনিয়া, ইরাক ও গ্রিসের অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছিল হিট্রাইট সাম্রাজ্য। দেশের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত আরারাত পর্বতের চুড়োয় এসে স্থিত হয়েছিল নূহের কিশ্তি; যার ধ্বংসাবশেষে এখনো দৃশ্যমান (বর্তমানে আর্মেনিয়ায়)। এরপর এই তুর্কিস্থান খ্যাতিমান হয়ে ওঠে ফ্রিজিয়ান, লিডিয়ান, ট্রোজান ও পার্সিয়ানদের দ্বারা। মহামতি আলেক্সান্ডার একে আরো খ্যাতিমান করে তোলেন সিরীয়, ইরাকি ও মিসরীয়দের পরাজিত করে। এরপর মধ্য এশিয়ার স্তেপবাসী, যারা এখন কুর্দি নামে খ্যাত, পাঁচ শ’ বছর এলাকাকে শাসন করে সেলজুক ও ওসমানী বংশের নামে। ১৯২৩ সালে কামাল আতাতুর্কের হাতে জন্ম হয় নব্য তুরস্কের। কিন্তু রাজ্য বা রাজা যতই বদলাক না কেন, ইস্তাম্বুল রয়ে গেছে রানীর আসনে।

ইতিহাস বা প্রাচীনে দেখা যায় খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে সেনাপতি বাইজাস এই নগরীর গোড়াপত্তন করেন। শ্র“তি আছে যে, মিগ্রানদের নিয়ে দলপতি বাইজাস ডেলফির মন্দিরে পূজা দিতে গিয়ে দেবীর কাছে জানতে চান কোথায় আমি অমরত্ব পাব? জবাবে দেবী জানান, অন্ধদের নগরীর উল্টা পাড়ে। মিগ্রানদের নিয়ে বাইজাস নানা নগর-বন্দর ঘুরে বসফরাসের পূর্ব পাড়ে পৌঁছেন। পশ্চিম পাড় তখনো বিজন পাহাড়। এই অসাধারণ ভৌগোলিক সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করায় পূর্ব পাড়ের বস্তিবাসীকে বাইজাস ‘অন্ধ’ হিসেবে অভিহিত করেন। তার আদেশেই পশ্চিম পাড়ে গড়ে ওঠে বাইজেন্টিয়াম শহর। পরবর্তীকালে কনস্টান্টাইন এর নতুন নামকরণ করেন কনস্টান্টিনোপ্ল। কিন্তু এশিয়ানদের কাছে বরাবরই শহরটি ইস্তাম্বুল নামে পরিচিত।

গত চার হাজার বছরে ইস্তাম্বুলের নাম সাতবার পরিবর্তিত হয়েছে বাইজেন্টিয়াম, কনস্টানটিনি, কনস্টান্টিনোপ্ল, কনস্টান্টিপোলিস, স্টিম্পল, এস্তানবুল, ইস্তাম্বুল ও ইস্তানবুল (বর্তমান অফিসিয়াল নাম)। নামের মতোই বিচিত্র এর অবরোধের ইতিহাস। এ শহরের হাতে জিঞ্জির পরিয়েছেন পার্সি সম্রাট দারিয়ুস (৫২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে); এথেন্সের আলসিবিয়াদেস (৪০৮ খ্রি:পূ:); মেসিডোনিয়ার ফিলিপ-টু (৩৩০ খ্রি:পূ:); আরবীয় বাহিনী (৬৭৩-৭৮; ৭১৭-১৮); বুলগেরিয়ান আক্রমণকারীরা (৮১৩; ৯১৩); চতুর্থ ক্রুসেডার বাহিনী (১২০৩-১২০৪) এবং সর্বশেষ ব্রিটিশ, ইতালি ও ফ্রান্সের যৌথ কমান্ড (১৮১৮-২৩)।

আনোয়ার হাসতে হাসতে বলল, যদি একেকবারের শৃঙ্খল দিয়ে একেক জোড়া চুড়ি বানানো হতো, ইয়াসমিনার হাতে আঁটত না।
একুশ হাজার নীল টাইলসের দ্যূতিকে ম্লান করে দিয়ে ইয়াসমিনা এক পাক ঘুরল। তার ঝিলিমিলি স্কার্টের ঢেউ খেলানো প্রান্ত এমন ফণা তুলল যে আমরা সভয়ে পিছিয়ে এলাম। ডোন্ট ফান উইথ মি, জেন্টলম্যান। জানো তো, একজন তুর্কি যুবতী চাইলে একদল উচ্ছৃঙ্খল শ্বেতাঙ্গ সৈন্যকেও হাঁটুর নিচে নামিয়ে রাখতে পারে?

আমি দু’জনের ঝগড়া দেখতে আগ্রহী ছিলাম। আনোয়ারের মতো কোমল ছেলে আর ছুরির মতো ধারালো ইয়াসমিনার দ্বন্দ্ব নিশ্চয়ই আকর্ষণীয় হতো। কিন্তু আরবীয় চরিত্রের আমরা কতটুকুই বা বুঝি! ইয়েমেনি যুবক রাগ করার বদলে প্রশংসায় সরব হলো হেলুয়া হেলুয়া। ইয়াসমিনা, তুমি সত্যিই সুন্দর।

আর এটুকু প্রশংসা কানে যেতেই ইয়াসমিনা মোমের মতো গলে গেল। তার পদ্মগোখরা রাগ যেন মোতির কোমল আলোয় নীলাভ মসজিদের দ্যূতি হয়ে গেল। হাত ধরে আমাদেরকে সে নিয়ে এলো কফিশপে।

টপকাপির মূল প্রাসাদের দু’টি ভাগ বাইরুন ও অন্দেরুন বহির্বিভাগ ও অন্দরমহল। যে চারটি স্তরে এই প্রাসাদ থরে থরে গড়ে উঠেছেÑ তার দু’টি বাইরুনে, দু’টি অন্দেরুনে।

হুমায়ুন বা রাজফটক দিয়ে আমরা টপকাপিতে ঢুকলাম। ১২০ শয্যার একটি হাসপাতাল, বেকারি, অস্ত্রাগার, গুদামঘর, ধোপাখানা ও গার্ডদের কোয়ার্টার নিয়ে এ এলাকা। আলা-ময়দানি (প্যারেড স্কোয়ার) পার হতে সাত আট মিনিট লাগল। বাব-উস-সালাম বা শান্তি দরোজা দিয়ে আমাদেরকে ভেতরে নিয়ে গেল ইয়াসমিনা। এখানেই রাজকীয় দিওয়ান বা ‘দরবার’। সপ্তাহে চার দিন দরবার বসার রেওয়াজ জারি ছিল সাড়ে তিন শ’ বছর। পেছনের দিকে পাথরের জালি ঘেরা ঝরোকা সুলতান যার ওপাশে বসে এ দিকটা দেখতে পেতেন, কিন্তু তাকে কেউ দেখতে পেত না। ঠিক এ রকমই একটি ঝরোকা আছে আকবরের পরিত্যক্ত রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে। মনে পড়তেই আমার গা শিহরিত হলো। কত দূর, অথচ কত মিল!

দিওয়ানের দু’টি অংশ উজিরের দরবার ও মোহাফেজখানা (রেকর্ড রুম)। দেওয়ানের ওপাশেই বিশাল রন্ধনশালা। আমরা অবাক না হয়ে পারলাম না যে বিজ্ঞানের সেই অনগ্রসর সময়ে কী অসাধারণ টেকনিকে খাবার গরম রাখা হতো; পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা হতো এবং নিরাপত্তা মোহরেরও ব্যবস্থা ছিল। রন্ধনশালায় যে চীনামাটির বাসন-কোসন দেখলাম, তা আমার কল্পনাকে প্রচ ঝাঁকি দিলো। ইয়াসমিনা হেসে বলল, মাই ফ্রেন্ড, ডোন্ট বি অ্যামেজ্ড। দিস ইজ দ্য থার্ড লার্জেষ্ট পোরসিলিন কালেকশন অব দ্য ওয়ার্ল্ড!

রাজকীয় পাতাকাবেদির (ঝা া-এ-খলিফা) পাশেই খোজাদের কোয়ার্টার। বাব-উস সাদ (আনন্দ-দুয়ার) পার হয়ে আমরা অন্দেরুনে ঢুকলাম। প্রথম আঙ্গিনার নাম আর্জ ওদাসি (শ্রবণ কক্ষ)। মন্ত্রিপরিষদ বা বিদেশী দূতদের সাথে সুলতানের সাক্ষাৎকারের জায়গা এটি। এর পরেই সুলতান আহমদ-টু’র কিতাব মহল। ডান দিকের ঘরে সুলতানের ব্যক্তিগত পোশাকাদি এবং বাম দিকে টপকাপি-হানসেরি বা খঞ্জরগৃহ। এখানে ‘কাসিকাস্’ নামে ৮৬ ক্যারেটের বিশাল এক হীরকখ যেকোনো দর্শককে নির্বাক করে দিতে বাধ্য। পার্সি সুলতান নাদির শাহকে উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছিল এটি। কিন্তু যাত্রাপথেই খবর আসে যে নাদির শাহ্ নিহত হয়েছেন। তখন থেকেই হীরাটি এখানে আছে চার পাশে ঊনপঞ্চাশটি ক্ষুদ্র হীরার স্থায়ী গার্ড অব অনার নিয়ে।

পরের ঘরে সাজানো বিশ্বখ্যাত তুর্কি ক্যালিগ্রাফির সুবিশাল সংগ্রহ। পাশের রুমটি নিñিদ্র নিরাপত্তায় আটকানো সেখানে সংরক্ষিত হজরত মুহাম্মদ (দ:)-এর চাদর, তরবারি, সিলমোহর, দাঁত, দাড়ি ও পদছাপঅলা পাথর। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন খলিফা ও সুলতানদের উল্লেখযোগ্য নানা জিনিস। আমাকে বিস্মিত করল সাহাবিদের হাতে (চামড়ায়) লেখা কুরআন। আশ্চর্য নিপুণ এবং অবিকৃত সেই হরফমালা। এটিকে চুরি করার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে এক অসাধারণ পরিকল্পনা করেছিল পাশ্চাত্যের খ্র্ষ্টিানরা। ইউ ক্যান্ট উইন দেব অল ছবির সেই বিখ্যাত চোর টনি কার্টিসের কথা আমার মনে পড়ল। যাকে পাঠানো হয়েছিল তুর্কিদের উন্নতির মূলে যে কুরআন রয়েছে তা হাতিয়ে নেয়ার জন্য। মাত্র দেড় শ’-দুই শ’ বছর আগেও ব্রিটিশ-মার্কিনরা ইসলাম সম্পর্কে কতটা অজ্ঞান ভাবলে হাসিই পায়।

সন্ধে হয়ে এসেছে। পায়ের ব্যথায় হাঁটতে না পেরে বললাম, ইয়াসমিনা, আই নিড কফি অ্যান্ড রেস্ট।
ওকে! খুব তাচ্ছিল্যের সাথে সে আমার দিকে তাকাল। তার করুণাকাতর দৃষ্টিতে ভর্ৎসনা ঝরে পড়ছে এত দুর্বল হলে চলে? তাও পুরুষ মানুষের?
কফিশপে এসে আমায় একটা গাইড প্রেজেন্ট করল আনোয়ার। টপকাপি প্যালেসের প্রথমেই লেখা লাইফ অ্যাট হারেম। আমি হেসে বললাম, এখনো কি হারেম আছে তুর্কিস্তানে?
আরবরা তুরস্ককে বলে তুর্কিয়া। আনোয়ার জবাব দিলো হারেম তো সমগ্র মুসলিম বিশ্বেই আছে। কিন্তু এ প্রশ্ন কেন? তুর্কিয়ায় হারেম না থাকা মানে হাম্মাম না থাকা। সেটি কি সম্ভব?
হারেম সম্পর্কে আমার পরিষ্কার ধারণা আছে। পাশ্চাত্যে যে শব্দটি কল্পনার রঙে রঞ্জিত আরব বিশ্বে তা নিরাপত্তা ও সম্ভ্রমের প্রতীক। হারাম বা নিষিদ্ধ শব্দ থেকেই এর উৎপত্তি। অন্দরমহল বা ভেতরবাড়ি বোঝাতেই এর প্রচলন যা পরপুরুষের জন্য বেআইনি এলাকা বলেই এর নাম হারেম। কিন্তু পাশ্চাত্যের প্রচারণা এমন যে, হারেম মানেই ভোগের জন্য ধরে আনা শত শত সুন্দরী তরুণীদের আস্তানা, যারা সুলতান বা আমির-ওমরাহের কামনা নিবারণে রত। আসল বিষয়টি মোটেই সে রকম নয়।
মিসরের এক ভার্সিটির ছাত্রী একবার আমায় এই যুক্তিতে হার মানতে বাধ্য করেছিল যে আমি যদি ভালো নাচতে না শিখি, আমার স্বামীর মনোরঞ্জন করব কিভাবে?

আরবদের যেসব বিষয় পাশ্চাত্যে ও দূরপ্রাচ্যে সাংঘাতিক বিকৃতভাবে পরিবেশিত হারেম তার অন্যতম। এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন মুসলিমবিদ্বেষও লক্ষণীয়। অথচ এসব প্রচারকারীদের সামনে কেউ যদি চ্যালেঞ্জের সুরে বলে যে, মহামান্য আলেক্সান্ডারের সাথে প্রায় পাঁচ হাজার নারী-সঙ্গিনী ছিল, কিংবা তিনি বিয়ে করেছিলেন তিন-তিনবার, তাহলে এরা লেজ গুটিয়ে পালায়।

হারেমের আনুষ্ঠানিক রূপ এই টপকাপি প্যালেসেই হয়েছে। বাইজেন্টিয়ানরাই এই ধারণার বাহক। আনাতোলিয়ার চমৎকার প্রকৃতি ও অসাধারণ আবহাওয়া তাদের এ কল্পনাকে আরো পোক্ত করেছে মাত্র। প্রথমে হারেম মানে ছিল আনাতোলিয়া নদের ফ্যামিলি-কোয়ার্টার। পুরুষদের মধ্যে যেমন জানেসারি, যাদেরকে বিজিত খ্রিষ্টান এলাকার সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে ধরে এনে সুশিক্ষিত মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলা হতো হারেমও তারই নারী রূপ। সুলতানের মা, বোন, নিকটত্মীয়া এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ স্ত্রীরা এখানে প্রতিপালিত হতো কঠোর শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণে। ওয়ালিদে সুলতান বা সুলতানের মা হতেন হারেমের প্রথাগত অধিকর্ত্রী। হারেমের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকত কালো খোজারা।

সে যুগে মা-বাবারাই সুন্দরী তরুণী কন্যাকে হারেমে পাঠাতে পারলে ধন্য হতেন। কারণ হারেম ছিল আভিজাত্য এবং সুলতানের সাথে আত্মীয়তার প্রতীক। এ ছাড়া মেয়েদেরকে কিনেও উপহার পাঠাতেন উচ্চ রাজন্য ও পরিষদরা। কখনো পার্শ্ববর্তী দেশ থেকেও তরুণীদের উপঢৌকন পেতেন সুলতান।

হারেমের মেয়েদেরকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা হতো ১. ওদালিক বা সাধারণ পরিচারিকা; ২. গেদিল্কি বা খাস পরিচারিকা (এদের সংখ্যা সব সময় ১২ জনে সীমিত থাকত); ৩. ইকবাল বা গোজ্দে যারা ছিল সুলতানের প্রিয়ভাজন কখনো কখনো অংকশায়িনী; এবং ৪. কাদিন বা হাসেকি-সুলতান যাদের ঔরসে তার সন্তান জন্মাত। শেষের দলের প্রায় সবাই আনুষ্ঠানিক স্ত্রী হতেন এবং এদের মধ্যে যিনি প্রথম পুত্রসন্তান প্রসব করতেন তিনিই পরবর্তী ওয়ালিদে সুলতান বা রাজমাতা হতেন।
হারেমের নারীদের বাদ্যযন্ত্র, সঙ্গীত, নৃত্যকলা, লেখালেখি, সুচিকর্ম এবং অঙ্কন শিল্পে পারদর্শী হতে হতে। তারা এখানে বন্দী জীবনযাপন করতেন না। তাদের বাইরে বেরোবার জন্য পর্দাঢাকা গাড়ি ছিল। বছরে দু’বার তারা পিতা-মাতার বাড়িতে এবং মাসে একবার বসফরাসের অবকাশ কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে যেতেন রাজপ্রাসাদের আচার-আচরণ শিখতে। সুলতান নিজে এসব পার্টি থেকে পরবর্তী স্ত্রী বাছাই করতেন তাদের জ্ঞান, দক্ষতা, রুচি ও পরিবেশনা বিচার করে।

কালো খোজাদের সর্দারের নাম ছিল কিজলার-আগাসি। তাকে বলা হতো সুলতানের মর্জি ও ইচ্ছার গোপন রক্ষক। বিস্ময়ের ব্যাপার, প্রায় চার শ’ বছরের ওসমানী আমলে কোনো আগাসি কখনো বিদ্রোহ করেনি। বিশ্বাস ঘাতকতারও কোনো নজির নেই টপকাপি প্যালেসে!
কিন্তু খোজা বা হারেমের চেয়ে পৃথিবীকে বেশি বিস্মিত করেছে জানেসারিরা। সে গল্প সময়ে হবে।...

সন্ধ্যার আধো অন্ধকার গ্রাস করেছে বসফরাসের সোনালি কোমর। আমরা হাঁটতে আরম্ভ করলাম সুফি মিউজিক কনসার্টের দিকে। ঘূর্ণনরত দরবেশদের অনুষ্ঠানের টিকিট কেটে রেখেছে ইয়াসমিনা। মাওলানা রুমির অনুসারী এই কবিদের এই আশ্চর্য অনুষ্ঠান পশ্চিমা বিশ্বে অনেক রহস্য ও বিকৃতির জন্ম দিয়েছে। বহু সমালোচক ব্যালে ড্যান্সের সাথে দরবেশদের ঘূর্ণিনৃত্যকে এক করে ফেলেছেন!
অ্যাটলাস ও আলকাজার সিনেমা হল পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম কাদেশি টানেলে। আজ শনিবার। পুরো রাস্তাজুড়ে উদ্দাম নৃত্যের ঝনঝনা। ব্যালে ড্যান্স, ডিসকো এবং নিষিদ্ধ এলাকার হাতছানিতে ঝলমলাচ্ছে চার দিক। মদ ও হাশিশের গন্ধে আমি ক্লান্ত হয়ে বললাম, ইয়াসমিনা, আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চলো, প্লিজ। আরেকটু সুন্দর মানুষের কাছে!

তরুণ-তুর্কি ভুল বুঝে বলল, আমি ভাবিনি জেনেলেভ তোমার পছন্দ।
আমি হাঁ করে রইলাম।
তুর্কিতে জেনেলেভ মানে পতিতালয়। রাশিয়ান ও পূর্ব ইউরোপিয়ান মেয়েরাই এখানকার প্রধান দোকানদার। তুর্কিরা তাদের ব্যবহার করলেও তাদেরকে খাটো চোখে দেখে।
আনোয়ার বিষয়টা ধরতে পেরে হাসতে হাসতে বলল, আমি তোমায় বলিনি, সারোয়ার, ভালো লোকদের ভাগ্য খারাপ হয়?
ইয়াসমিনাকে গুডবাই বলে আমরা এগিয়ে চললাম দরবেশদের আস্তানায়। ইয়াসমিনার অবাক চোখে তখনো দ্বিধা ও সন্দেহের মেঘ।
সব মেঘে কি বৃষ্টি হয়? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি ভাবলাম, মানুষের জীবনটাই এ রকম আশ্চর্য স্ববিরোধিতার সমষ্টি। আমার ক্লান্ত শরীরকে সাফ করার জন্যই যেন ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। ইয়াসমিনা ছুটে এসে বলল স্যরি, ফ্রেন্ড! তোমাদের টিকিট দেয়া হয়নি। এই নাও!
আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম, তার চোখে মিনতি ও অনুতাপ।

বৃষ্টিতে ভিজে ইয়াসমিনা শরীর হয়ে উঠেছে ধারালো ও লোভাতুর। আনোয়ার যেন তাকে উপেক্ষা করার জন্যই বলল, মেনি মেনি থ্যাংকস, ইয়াসমিনা। এবার তুমি ঘরে যাও।
কেন, তোমরা দরবেশদের ওখানে যাবে না?
না। আনোয়ারের গলায় মিথ্যে হয়ে উঠল তীক্ষ ও বিদ্রপাত্মক, আমরা এখন জেনেলেভে যাচ্ছি। সেখানে হেলেন অব ট্রয়কে খুঁজব। কেমন?
ইয়াসমিনা মুখ কালো করে পা বাড়াল পেছন দিকে। আমি অবাক হয়ে দেখি, আনোয়ার পেছন ফিরে চোখ মুছছে। আমি তার চোখে ধরা না পড়ার জন্যই রাস্তা থেকে একটা কাগজ কুড়ানোর ভান করলাম। একটি ট্রাভেল কোম্পানির লিফলেট। ট্রুভা (ট্রয়) নগরীতে যাওয়ার বিবরণ। তিন দিনের জন্য প্যাকেজ জনপ্রতি খরচ ১৫০ ডলার; উইদ বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট।

আনোয়ার হেসে আমার হাত থেকে নিলো সেটি। কাল আমরা যাব সেখানে ইয়াসমিনাও সাথে থাকবে। আমি তার দিকে ফিরে সেই প্রাচীন প্রবাদটি মেনে নিতে বাধ্য হলামবেদুইনদের চেয়ে রহস্যময় মানুষ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই!

Don't Miss A Single Updates

Remember to check your email account to confirm your subscription.

Blogger
Disqus
Post a comment ➜

No Comment